উপলব্ধি- মুহাম্মদ ফজলুল হক
এই শহরে কেবল দুঃখ ভাসে। পথে-ঘাটে, অলিতে-গলিতে, মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও বিদ্যালয়ে। ভালোবাসা, প্রেম ও অপ্রেমে নিয়মিত ভাসে। কথা বলে। কেউ শোনে না। কেবল একজন শোনে। কথা বলে। নাম তার মালতী।
মালতীকে দুঃখ খোঁজে, কিংবা মালতী খোঁজে দুঃখকে। হাহাকার করা দুঃখ মানিয়ে নিতে মালতী যেন প্রস্তুত। দুঃখও যেন জানে শহরে মালতী ব্যতীত কেউ তার কদর করবে না, গুরুত্ব দেবে না। তাই তো সেও মালতীকে বোঝে। সর্বদা তার উপর বর্ষিত হয় না। মাঝে মাঝে বহু দূরে চলে যায়। অনেক দূরে। মালতী নাগাল পায় না। বাধ্য হয়ে সুখের বাতাসে ভাসে মালতী।
সুখ মালতীর কাছে অস্বস্তিকর। অচেনা। দুঃখবোধ উপভোগ করে সে। দুঃখ তার সত্ত্বাকে জাগ্রত করে। মানবিকতা উগ্রে দেয়। মন নিয়ন্ত্রণে রাখে। মানুষ ও পরিবেশ উপলব্ধিতে সহজ হয়। মালতীর কাছে দুঃখ যেন সতর্কবার্তা, এলার্মের মতো। যখন তখন এসে জানিয়ে দেয় সে একা নয়।
কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে আছে মালতী। স্টেশনের বিশালতায় মুগ্ধ। স্থপতির প্রশংসা না করে উপায় নেই। জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার নিশ্চয়ই তাঁর মাথায় ছিল। ধন্যবাদ জানায় সে ড্যানিয়েল ডানহাম ও বব লুইকে।
লোকজনের ভিড়, কোলাহল, ছোটাছুটি, হাঁকডাক সব মিলিয়ে স্টেশন যেন এক জীবন্ত শহর। সাথের লোকজন কক্সবাজার ভ্রমনের আনন্দে ব্যস্ত। কিছুক্ষণ পর কক্সবাজার এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠবে। ট্রেন সরাসরি চট্টগ্রাম হয়ে কক্সবাজার পৌছাবে। অথচ মালতী জানে ট্রেন নিদিষ্ট সময়ে পৌঁছাতে পারবে না। ইঞ্জিন বিকল হয়ে থেমে থাকবে সালাদনদী ও শশীদল স্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে। ট্রেনের পূর্বদিকে ভারতীয় সীমান্ত। পশ্চিমে বাগরা
ফকির বাড়ি। ফকির বাড়িতে ছিলেন এক সাধক মানুষ। মালতীর বাবা ছিলেন সাধক মানুষের ভক্ত। বাবার মাধ্যমে মালতী দুঃখবোধ আগাম উপলব্ধির শক্তি অর্জন করে।
স্টেশনের গুঞ্জন থেকেও যেন বহু দূরে মালতী। ব্যস্ত প্ল্যাটফর্ম, কুলির হাঁকডাক, ট্রেনের শিস, যাত্রীর কোলাহল সবই মালতীর চিন্তার বাইরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে যাত্রা করবে। ট্রেন তাকে নিয়ে যাবে অচেনা পথে। সে জানে সামনে কী অপেক্ষা করছে। তবুও অনিশ্চয়তা। মালতী জানালা দিয়ে বাইরে তাকায়। শহরে নতুন ভবনের পাশাপাশি ভাঙাচোরা ভবন, মানুষের ভিড়, পথশিশুদের ছুটোছুটি এসব কিছু তার চিন্তাকে ভারী করে তোলে।
কক্সবাজার এক্সপ্রেস ধীরে ধীরে স্টেশন ছাড়ে। চাকার ধাতব শব্দে ছন্দ তৈরী হয়। মালতীর পাশের সিটে মধ্যবয়স্ক এক নারী ব্যাগ খুলে পান চিবোতে ব্যস্ত। তার দিকে তাকিয়ে সে হালকা হাসে। কোনো কথা বলে না। নারীর মুখে
পানজর্দার লাল দাগ। চোখেমুখে ক্লান্তির রেখা। মালতী অনুভব করে এই নারীর জীবনে নিশ্চয়ই দুঃখের গভীর কোনো ছাপ রয়েছে।
ট্রেনের গতির সাথে সাথে রাত গভীর হয়। জানালার বাইরে অন্ধকার ধীরে ধীরে গাঢ় হয়। ট্রেনের আলো মাঝে মাঝে চলতি পথের গাছপালাকে আলোকিত করে। মালতী ট্রেনের ধাতব শব্দের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। শব্দের সঙ্গে যেন আত্মিক সম্পর্ক।
রাত প্রায় দুটো। ট্রেন সালাদনদী ও শশীদল স্টেশনের মাঝামাঝি এসে আচমকা থেমে যায়। যাত্রীদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়। কেউ জানে না কী হয়েছে। মালতী জানত এমন কিছু হবে। তবু মনে হয় কোনো যান্ত্রিক সমস্যা হয়েছে। ট্রেনের আলো জ্বলছে। অদ্ভুতভাবে চারপাশ নিস্তব্ধ।
কিছুক্ষণে মধ্যে ঘোষণা আসে ইঞ্জিন বিকল হয়েছে। অনেক যাত্রী বিরক্ত হয়ে ওঠে। কেউ কেউ অভিযোগ করতে থাকে। মালতী ধৈর্য ধরে অপেক্ষা
করে। জানালার বাইরে তাকিয়ে দূরের অন্ধকারে হারিয়ে যায়।
ট্রেনের বাইরে থেকে হালকা সুর ভেসে আসে। মরমী গানের সুর। গভীর রাতের নীরবতায় সেই সুর যেন রহস্যময় হয়ে ওঠে। মালতীর মনে পড়ে বাবার কথা। বাবা বলতেন, “যে দুঃখের সুর শুনতে জানে, সে সুখের গানও শুনতে পারে।”
ট্রেনের সামনের দিকে তাকিয়ে মালতী ধীরে ধীরে কামরা থেকে নেমে আসে। শীতল মাটির ওপর পা রাখে। আশেপাশে বন-জঙ্গল। দূরে কোথাও রাতের পেঁচার ডাক। মালতী অনুভব করে এই রাত, থেমে থাকা মুহূর্তের মধ্যেও নিশ্চয়ই গভীর অর্থ আছে।
দূর থেকে এক বৃদ্ধ ধীর লয়ে এগিয়ে আসে। পরনে অস্পষ্ট পোশাক। হাতে লাঠি। চেহারায় আশ্চর্য রকমের প্রশান্তি। বৃদ্ধ মালতীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসে।
“মেয়ে, দুঃখের পথই তোমার পথ, তাই না?”
চমকে ওঠে মালতী!
“আপনি আমাকে চেনেন?”
“আমি চিনি না, কিন্তু দুঃখ তোমাকে চেনে। দুঃখের পথিক এক সময় আমাদের পথেই এসে পড়ে।”
মালতীর মনে হয় এই বৃদ্ধ সেই সাধক, যার কথা বাবা বলতেন।
“আপনি কি ফকির বাড়ির?”
বৃদ্ধ হাসেন।
“আমি দুঃখের পথের পথিক, তোমার মতোই।”
মালতী কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
তারপর বলে, “দুঃখ আমাকে পথ দেখায়। তবে আমি জানি না এর শেষ কোথায়।”
বৃদ্ধ মাথা নাড়েন। “শেষ বলে কিছু নেই। দুঃখ ও সুখ দুটো একই পথের অংশ। একটাকে ছাড়া অন্যটাকে পাওয়া যায় না।”
মালতী গভীরভাবে বৃদ্ধের কথা শোনে। তার মনে পড়ে শৈশবের কথা। বাবার হাতের আঙ্গুল ধরে হেঁটে হেঁটে যখন সে নদীর ধারে যেত। তখনও
রহস্যময় এক বৃদ্ধের সাথে দেখা হয়েছিল।
"কখনো থেমে যেতে হয় শুধু উপলব্ধির জন্য",
বৃদ্ধ বলেন।
মালতী বুঝতে পারে এই যাত্রা নিছক ট্রেনযাত্রা নয়। জীবনের যাত্রা। ট্রেন তখনো স্থির, যাত্রীরা অপেক্ষায়। মালতীর মনে হয় সে যেন অন্যরকম যাত্রার পথে এগিয়ে যাচ্ছে।
বৃদ্ধ ধীরে ধীরে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়।
ভোর হওয়ার আগে ট্রেন ঠিক হয়। যাত্রীরা তাদের জায়গায় ফিরে আসে। জীবনের যাত্রায় আশান্বিত হয়। ট্রেন আবার চলতে শুরু করে। জানালার বাইরে প্রথম আলোর আভা দেখা যায়।
মালতী জানালার কাচে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে। মনে হয় দুঃখ তার সঙ্গী হয়েই থাকবে।
দুঃখের ভেতরে লুকিয়ে আছে অন্যরকম প্রশান্তি।
কমলাপুর স্টেশন ছেড়ে আসার পর থেকে দীর্ঘ যাত্রা পেরিয়ে মালতী বুঝতে পারে দুঃখ থেকে পালানো যায় না। তবে দুঃখ জীবন বুঝতে শেখায়।
এটাই হয়তো সত্যিকারের পথচলা।
ট্রেন গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে। মালতী জানে, অনেক পথ বাকি। যে পথ তার উপলব্ধির বাহিরে।
আরও পড়ুন- মুহিব্বুল্লাহ ফুয়াদের গল্প