Header Ads

Header ADS

বুকফাটা আর্তনাদ বাতাসের খামে- মুহিব্বুল্লাহ ফুয়াদ - গল্প



তিন মাস পর বাড়ি যাচ্ছে রফিক। মনে যতটা আনন্দ থাকার কথা ততটুকু নেই। গত তিন মাস আগেও সায়েম ও  রফিক এক সাথে বাড়ি গেছিলো। পরীক্ষার ছুটিতে। সায়েমের ইচ্ছে পূরণের জন্যই ট্রেনে উঠেছিলো রফিক। সেই কবে নাহবেমীর জামাতে পড়াকালীন সময় ট্রেনে উঠেছিলো রফিক। তখনও সাথে ছিলো সায়েম। আরো ছিলো জুবায়ের, নাহিদ ও রাইহান। সেদিন উত্তপ্ত রোদের খরতাপে ও মানুষের জ্যামে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো তারা। বসার জায়গাগুলো ছিলো মানুষে কানায় কানায় ভরপুর। পা রাখার জায়গা ছিলো না। কেউ কেউ এক পায়ে দাঁড়িয়েছিলো দীর্ঘ সময়। 

ভৈরব স্টেশনে পৌঁছলে কিছুটা ভীড় কমতে থাকে। এই ফাঁকে রফিকরা সিট পেয়ে যায়। দীর্ঘ ক্লান্তির পর একটু স্বস্তি পেয়ে বিভোর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে তারা। একদম কিশোরগঞ্জ পৌঁছে ঘুম ভাঙে। নাহিদ খেয়াল করে রফিকের পাঞ্জাবির পকেট কাটা। সায়েমের'ও। ভয়ে নিজের পকেটে চোখ ফেলতেই ডাকাডাকি শুরু করে,এই রফিক! সায়েম! দে..খ! আমাদের পকেট কাটা গেছে। কোনো কিছুই অবশিষ্ট নেই। সবাই হুড়মুড় করে ঘুম থেকে উঠে নিথর হয়ে বসে রয়। কী থেকে কী হয়ে গেলো কিছুই বুঝতে পারলো না। রফিক কান্না শুরু করলো। বড় ভাইয়ের দেয়া নতুন এন্ড্রুয়েড মোবাইলটা নিয়ে গেছে চোরে। এই মোবাইলে মিশে আছে আবেগ ভালোবাসা ও অনুভূতি । 

দূরের সিলেটে একমাত্র ছোট ভাই পড়ছে—এই ভেবে যোগাযোগের সুবিধার জন্য কিনে দিয়েছিলো মোবাইলটা।  কিন্তু সামান্য ঘুম তার সেই মোবাইল ক্ষয় করে দিলো। কী বলবে ভাইয়াকে? কী দিয়ে বোঝাবে মা'কে? সবার পকেটের টাকাপয়সা যা-কিছু ছিলো সবই নিয়ে গেছে। সবাই ভেঙে পড়ে। টিটিকেই বা কি দিয়ে বোঝাবে যে তাদের’ও টিকিট ছিলো। সিলেটে করা সেই টিকিটগুলো নিয়ে গেছে চোরে। এদিকে কারো হাতেও নেই কোনো টাকা। অনেকটা পেরেশান হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ পর-ই টিটি এসে টিকিট চাইলো। তারা তাদের অবস্থা বর্ণনা করে টিটির হৃদয় ছুঁতে পেরেছিলো। যার ফলে সেদিন কোনোরকম বেঁচে গেছিলো। এরপর রফিক আর কোনোদিন ট্রেনে উঠে নি। 


রফিক ও সায়েমের সম্পর্ক অনেক দিনের। সেই ছোটবেলা থেকেই এক সাথে পড়াশোনা করছে। যেখানেই যাচ্ছে দু'জন জমজ ভাইয়ের মত একে অপরের সাথে লেগে আছে। কেউ কাউকে ছেড়ে থাকতে পারে না। জালালাইনের বছর তারা ভিন্ন-ভিন্ন মাদরাসায় ভর্তি হয়েছিলো। কিন্তু থাকতে পারে নি। আবারো একই মাদরাসায় ভর্তি হয় দু'জন। এভাবেই দিন যেতে থাকে। 

এবার তারা দাওরায় পড়ছিলো যাত্রাবাড়ীর এক মাদরাসায়। বছরের শুরুতে সায়েম বিয়ে করেছিলো পরিবারের চাপে। তার স্ত্রী বর্তমানে পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। সেদিন সায়েম বলছিলো, বাড়িতে যেয়ে স্ত্রীকে চিকিৎসা করাবে। শরীরটা খুব ভালো যাচ্ছে না তার স্ত্রীর। তার মনে গেঁথে ছিলো ছোট ছোট অনেক স্বপ্ন। অসংখ্য আশার প্রদীপ জ্বালিয়েছিলো মনের কোণে। কত কী যে বলতো প্রতিদিন! বলাবাহুল্য। রাতে ঘুমোতে যাবার আগে দু'জন গল্প করতো। হাসিঠাট্টা করতো। এক রাতে বলেছিলো,রফিক আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোন! একদম দুষ্টুমি করবি না। ছেলেমেয়ে যা-ই হোক, তুই নাম রাখবি। তুই-ই ডান কানে আজান দিবি। আমি বাম কানে ইকামাত দেবো। বাচ্চা যখন একটু বড় হবে তখন তুই আমি ও আমার বাচ্চা মিলে একদিন কক্সবাজার ঘুরতে যাবো। সেদিন তোর সাথেও একটা লাল টুকটুকে বউ থাকবে। আমরা একই রিসোর্টে উঠবো। পাশাপাশি দু'টো রোম বুকিং করবো। ওখানে আমরা অনেক মজা করবো। কুদরতি নিয়ামত দেখবো। অনেক আনন্দ করবো। তুই সেই আনন্দের একমাত্র সাক্ষী হয়ে থাকবি। আর শোন! কিয়ামতের পরেও যেন আমাদের বন্ধুত্ব অটুট থাকে সবসময় সেই দোয়া করবি।কোনোভাবেই যেন আমাদের সম্পর্কে ফাঁটল না ধরে। আমি ভুল করলে ধরে দিবি।তুই ভুল করলে আমি ধরে দেবো। এতে অভিমান করবি না। আমরা আমাদের বন্ধুত্বের সাক্ষর রেখে যাবো এই পৃথিবীতে। যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। আজ সেই সম্পর্ক ছিন্ন করে সায়েমই চলে গেছে দূরের দেশে। যেখানে গেলে মানুষ আর ফেরে না। যেখানের খবর কেউ নিতে পারে না। 

বাস দ্রুত গতিতেই চলছে। কিন্তু মনে হচ্ছে বাসের চাকাগুলো অকেজো হয়ে গেছে। চলছে না। সময় যেন আটকে আছে মোবাইলের স্কিনে। রফিক জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরের সবুজ বাতায়নে। চোখে পড়ছে গাছ,ফুল,পাখি ও মানুষ। ফর্সা আকাশের মেঘ। কোনোকিছুই তার মনাকর্ষন করতে পারছে না। যেন সে এক অনুভূতি শূন্য নিথর পাথর। অথচ, সবসময় সে এই গাছপালা তরুলতা দেখে ভীষণ মুগ্ধ হতো। খুশিতে মাঝেমধ্যে দুয়েকটা ছবি তুলে নিতো মোবাইলে। কিন্তু আজ সব বিপরীত হচ্ছে। পর পর গাল বেয়ে ঝরে পড়ছে শোকাশ্রু। বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছে বারবার। কী যেন হারিয়ে ফেলেছে সে। হাজার বছরের প্রিয় মানুষ। প্রিয় বন্ধু। প্রিয় ভাই। দীর্ঘ সফর সঙ্গী।

স্মৃতিপটে ভাসতে থাকে গেলো বার বাড়িতে যেয়ে দু'জনের দিনগুলো। শৈশবের বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেয়ার মুহুর্তটুকু। সোয়াই নদীর কোলঘেঁষা জাম গাছটি। ভাসতে থাকে সেদিনের স্মৃতিচারণ। সায়েমের অতীতের গল্প। সায়েমের আবেগপ্রবণ কথাগুলো।তোর কী মনে আছে সেদিনের কথা? যেদিন অনিকের হাতঘড়িটা পড়ে গেছিলো এইখানে! তুই তখন সাঁতার জানতিস না। এক লাফে নেমে গেছিলি। আহা! সেদিন তো তুই মারাই পড়তি, যদি এখানে আমি না থাকতাম। মনে পড়ে যায় এই গাছে তাদের কত স্মৃতি গাঁথা আছে। বর্ষার দিনগুলোতে এখানেই তারা পিছলা খেলতো। এ গাছের ডালেই তারা হাফপ্যান্ট শুকাতে দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতো। মনে পড়ে নদীর জলে গোসল করে চোখ লাল করে বাড়ি ফেরার কথা। মনে পড়ে মা'য়ের লাঠিপেটার কথা। 

নিরবে কেঁদে কেঁদে বাড়ি পৌঁছে রফিক। বাড়ির পাশে মসজিদের মাঠভর্তি মানুষ। সবার চোখেমুখে বিষাদের চিহ্ন। সামনের সাড়িতে খাঁটিয়ায় শুয়ে আছে সায়েম। পাশেই ইমাম সাহেব নসিহত করছেন। মাঝেমাঝে ডুকরে কেঁদে উঠছে সায়েমের বাবা। তার ঘরের একমাত্র চাঁদ,হাফেজে কোরআন, নিকটবর্তী ভবিষ্যৎ আলেম, আদরের সন্তান দুনিয়ায় নেই। চব্বিশের অভ্যুত্থানের চারই জুলাই আছরের পর পুলিশের ছিটা গুলিতে আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলো। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর আজ সে গাজীর বেশে রবের কাছে পারি জমিয়েছে। গোড়া কাটা লাউগাছের নেতিয়ে যাওয়া ডাটার মতন দাঁড়িয়ে কান্না জড়িতে কণ্ঠে আকাশ-বাতাস ভারি করে জানাযা পড়ায় রফিক। কবরে রেখে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বুকফাটা আর্তনাদ বাতাসের খামে ছেড়ে দিয়ে আল্লাহর কাছে বলতে থাকে, হে প্রাণের মালিক!আমার বন্ধুকে তুমি যতনে রেখো!সে কীভাবে একা থাকবে? সে তো একা থাকতে পারে না!আমার বন্ধুর একাকীত্বের অন্ধকার জীবনের তুমি সঙ্গী হয়ে যেয়ো। সমবেত লোকেরা আমীন আমীন বলে আসমান কাঁপিয়ে তুলে। 

Powered by Blogger.